মাত্র আড়াই বছরের পথচলা হলেও, ‘রোর বাংলা’ নামটি এখন দারুণ পরিচিত হয়ে গেছে বাংলাভাষী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে। আমাদের দেশে শুধুমাত্র তথ্যভিত্তিক লেখা আর ভিডিও প্রকাশ করে এমন কোনো মিডিয়ার প্রায় সাড়ে সতেরো লাখ ফেসবুক ফলোয়ার থাকাটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! আর এমন কোনো প্ল্যাটফর্মের জন্য চৌদ্দ হাজারের বেশি রিভিউয়ারের কাছ থেকে গড়ে ৫ এ ৪.৭ রেটিং পাওয়াটাও সত্যিই একটা অভাবনীয় রকমের ভালো স্বীকৃতি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে মাত্র হাজারখানেক লাইক থেকে রোর বাংলা পেজটির আজকের অবস্থানে আসার পেছনে এই ভালোলাগাটা বুঝিয়ে বলা যাবে না। তবে এই যাত্রা কিন্তু আড়াই বছরের নয় কেবল, বাংলা’র আগেও শ্রীলংকাতে যেদিন প্রথম রোর যাত্রা করে, সেদিন থেকে পেরিয়ে গেছে আজ পাঁচ বছর। হোক লংকা, হোক বাংলা- রোর কিন্তু জয় করে নিয়েছে ৩টি দেশের ৫টি ভাষাভাষী পাঠক-দর্শকের মন!
“একদিন এশিয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম হয়ে ওঠা”- রোরের স্বপ্নটা সবসময় ছিল এরকমই। হয়তো কোনো একদিন সারা বিশ্ব জুড়েই নির্ভরযোগ্য তথ্যের অনন্য আধার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠবে রোর। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। আপাতত না হয় অতীতের গল্পটা শোনা যাক। কীভাবে শুরু হয়েছিল রোরের?
রোর মিডিয়া’র স্বপ্নদ্রষ্টা মুস্তাফা কাসিম নামের এক লংকান তরুণ। ২০১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেওয়ার আগে কখনোই তিনি ভাবেননি, একদিন একটি বহুজাতিক মিডিয়া হাউজ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবেন। একটা জিনিস তখন তাকে বেশ ভাবাতো, শ্রীলংকা নিয়ে তার হালনাগাদ থাকবার জন্য একদম প্রথাগত সংবাদপত্র ছাড় চোখ রাখার মতো আর কিছু ছিল না। কিন্তু এই কিছুটা তো থাকা দরকার। “শ্রীলংকাতে আসলে কী চলছে সেটা অনুভব করা যায় না ওগুলো পড়ে,” এটাই ছিল তার মত।
পরে তিনি কলম্বোতে ফিরে আসেন আর যোগ দেন পারিবারিক ব্যবসায়, কিন্তু প্রথাগত কর্পোরেট লাইফস্টাইল মোটেও ভালো লাগছিল না তার। নানান ভাবনা-চিন্তা একসাথে করে এরপর ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে তিনি শুরু করেন রোর মিডিয়া নামের একটি কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজ, যেখানে প্রকাশিত হতে থাকে শ্রীলঙ্কার চলমান ঘটনাবলী, লাইফস্টাইল, ব্যবসা, ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে লেখা।
প্রথম দেড় বছর ফ্রিল্যান্সার দিয়ে কোনোমতে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন মুস্তাফা। কিন্তু এরপর তিনি উপলব্ধি করেন, যত বড় স্বপ্ন দেখছেন, তাতে সাফল্যের দেখা পেতে হলে খাটতে হবে পুরোদমে পরিকল্পনা করে। এরপর শুরু হলো কীভাবে একটি কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম গুণগত মান বজায় রেখে সেইসাথে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে, সেটি নিয়ে গবেষণা। পার্ট টাইম থেকে ফুল টাইম কর্মী নেওয়া শুরু হলো রোরে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল একটি চমৎকার কন্টেন্ট টিম।
অক্টোবর ২০১৭-তে রোর পেয়ে গেল ডিজিটাল ইনোভেশন ফান্ড থেকে দারুণ এক বিনিয়োগ। আজিয়াটার শ্রীলংকান কোম্পানি ডায়ালগ জুড়ে গেল রোরের সাথে, একান্ত সহযোগী বিনিয়োগকারী হিসেবে। পরবর্তী পদক্ষেপটা ছিল সিংহলী আর তামিল ভাষায় রোর মিডিয়ার কাজ শুরু করা, যাতে পৌঁছানো সম্ভব হয় আরও অনেক শ্রীলংকানের কাছে। কিন্তু এরপর মুস্তাফা ভাবলেন, এশিয়ার আর দুই জনবহুল দেশ ভারত আর বাংলাদেশে যদি পৌঁছে যাওয়া যায় তাহলে পরিসর বেড়ে যাবে আরও শত গুণ। সিদ্ধান্ত হলো, বাংলাদেশেই আগে যাওয়া হবে।
২০১৬ সালের আগস্টে বাংলা ভাষায় যাত্রা শুরু করে রোর, নাম হয় রোর বাংলা। প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। পাঠক-দর্শকদের মাঝে দ্রুতই এত বেশি সাড়া ফেলে দিল রোর বাংলা যে, রোরের সবগুলো চ্যানেলের মাঝে বাংলাই হয়ে দাঁড়ালো এক নম্বর। বাংলাদেশের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এরপর ভারতে কাজ শুরু করে রোর হিন্দি।
কেবল আর্টিকেল নয়, তথ্যভিত্তিক ভিডিও নির্মাণেও যুগান্তকারী বিপ্লব নিয়ে আসে রোর বাংলা। বাংলা ভাষায় তথ্যমূলক ভিডিও তৈরি করেও যে অসংখ্য দর্শক পাওয়া যায়, সেটার সফল উদাহরণ দেখিয়েছে রোর। ন্যাটিভ অ্যাডভার্টাইজিং এর ধারণার সূচনা করে রোর এখন কাজ শুরু করেছে নামকরা সব ব্র্যান্ডের সাথেও। এইচএসবিসি, ইউএনডিপি, ডায়ালগ, ইউনিসেফ, নেসলে, মাইক্রোসফট, ইউনিলিভার, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, মিতসুবিশি, বিক্রয় ডট কম, বসুন্ধরা গ্রুপ, রূপায়ণ গ্রুপ, টয়োটা, স্যামসাং, হিরো, সুজুকি, বার্জার, স্কয়ার গ্রুপের মতো বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ড আর প্রতিষ্ঠানের সাথে রোর নিয়মিত কাজ করে চলেছে সৃষ্টিশীল বিজ্ঞাপন নির্মাণের তাগিদেও।
আড়াই বছরের পথচলায় সাড়ে সাত হাজারের বেশি আর্টিকেল আর চারশরও বেশি ভিডিও নির্মাণের কৃতিত্ব যেমন রোরের লেখক-সম্পাদক-নির্মাতাদের, তেমনি রোরকে মর্যাদা ও আস্থার জায়গায় আসীন করার মাধ্যমে দায়িত্বশীল করে তুলবার কৃতিত্ব শুধুই এর পাঠক-দর্শক-সমালোচকদের। টেবিলের উল্টোপাশ থেকে অর্থাৎ রোর বাংলার লেখক বা কর্মী হিসেবে এই দায়িত্বের জায়গাটুকু বোঝা যায় আরও বেশি। যখন রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে আপনি শুনতে পান পাশের টেবিলে কেউ কোনো একটি বিষয় নিয়ে জানবার জন্য বন্ধুকে বলছেন, “গুগলে এর সাথে রোর লিখে সার্চ দে” কিংবা গণপরিবহনে হঠাৎ আপনার পাশের তরুণ বা প্রবীণ সহযাত্রীর দিকে এক ঝলক চোখ পড়ে গেলে যদি দেখেন যে, তিনি মোবাইলে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন রোর বাংলার আর্টিকেল, তখন সত্যি সত্যি রোর নামটি নিয়ে ভালোবাসা আর গর্ববোধ হয়।
পাঁচ বছরের অর্জন যেন আরও বহুগুণে প্রতিফলিত হয় পরের পাঁচ বছরে। ভালো থাকুক রোর পরিবারের সবাই! স্বপ্ন এখনও অনেক দূর যাবার।